৯ টু ৫ চাকরি না ছেড়েও শেয়ার মার্কেট থেকে আয় করার উপায়: একটি পরিপূর্ণ গাইড
শেয়ার মার্কেট বর্তমানে প্যাসিভ আয়ের একটি চমৎকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তবে ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত চাকরি করা অনেকের পক্ষে এই সুযোগ নেওয়া কঠিন মনে হতে পারে। তবে, সঠিক পরিকল্পনা, সিস্টেমেটিক পদ্ধতি এবং মানসিক প্রস্তুতি থাকলে চাকরি ছাড়াই শেয়ার মার্কেট থেকে আয় সম্ভব। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব কিভাবে এই কাজটি করা যায় এবং কী কী কৌশল আপনাকে সফল হতে সাহায্য করবে।
১. শেয়ার মার্কেটের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া
শেয়ার মার্কেটে সফল হওয়ার জন্য দায়িত্বশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়া:
ট্রেডিংয়ে লাভ বা ক্ষতি যাই হোক না কেন, সিদ্ধান্তের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। কোথায় এন্ট্রি করবেন এবং কোথায় এক্সিট করবেন, তা সম্পূর্ণভাবে আপনার উপর নির্ভরশীল।
ভুল থেকে শেখা:
যদি কোনো সিদ্ধান্তে লস হয়, তাহলে সেই ভুলগুলো চিহ্নিত করুন। আপনার স্ট্র্যাটেজিতে কোথায় সমস্যা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করুন।
২. গ্রুপ ট্রেডিং থেকে দূরে থাকুন
অনেকেই গ্রুপ ট্রেডিংয়ের ওপর নির্ভর করেন, যেমন হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রাম গ্রুপ থেকে সিগন্যাল নেওয়া।
গ্রুপ ট্রেডিংয়ের সমস্যা হলো, এটি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের স্ট্র্যাটেজি এবং নিজস্ব সিস্টেম তৈরি করুন। নিজের সিদ্ধান্তে আস্থা রেখে কাজ করুন।
৩. নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বাড়ানো
ট্রেডিংয়ে সবচেয়ে বড় রোডব্লক হলো নিজের উপর আত্মবিশ্বাসের অভাব।
নিজেকে মোটিভেট করুন:
লস হলে হতাশ না হয়ে সেটিকে শেখার অভিজ্ঞতা হিসেবে গ্রহণ করুন।
হ্যাপি লস মেনে নিন:
ট্রেডিংয়ের ক্ষতিগুলোকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করুন এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হোন।
৪. সঠিক ট্রেডিং সিস্টেম নির্বাচন করা
৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত কাজ করার সময় ইন্ট্রাডে ট্রেডিং সম্ভব নয়। তাই আপনাকে সুইং ট্রেডিং বা পজিশনাল ট্রেডিং বেছে নিতে হবে।
সুইং ট্রেডিং:
৪-৫ দিন থেকে ১০-১২ দিনের জন্য ট্রেড।
পজিশনাল ট্রেডিং:
২-৬ সপ্তাহ বা তার বেশি সময়ের জন্য ট্রেড।
৫. সঠিক ইনস্ট্রুমেন্ট নির্বাচন
শেয়ার মার্কেটে বিভিন্ন ধরনের ইনস্ট্রুমেন্ট থাকে, যেমন স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড, কমোডিটি ইত্যাদি।
আপনার আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ইনস্ট্রুমেন্ট নির্বাচন করুন।
নিজের সময় এবং কাজের শিডিউল অনুযায়ী সঠিক ইনস্ট্রুমেন্ট বাছাই করুন।
৬. রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এবং মানি ম্যানেজমেন্ট
রিস্ক লিমিট সেট করুন:
প্রতিটি ট্রেডে আপনার পুঁজি কতটা ঝুঁকিতে থাকবে তা আগে থেকেই নির্ধারণ করুন।
স্টপ লস ব্যবহার করুন:
ক্ষতির সীমা নির্ধারণ করে রাখুন।
ডাইভারসিফিকেশন করুন:
আপনার ইনভেস্টমেন্ট একাধিক সেক্টরে ছড়িয়ে দিন।
৭. সঠিক সময় পরিকল্পনা করুন
৯-৫ চাকরি করার সময় শেয়ার মার্কেট নিয়ে কাজ করতে হলে সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
সকালে বা সন্ধ্যায় কিছু সময় শেয়ার মার্কেট বিশ্লেষণের জন্য রাখুন।
সপ্তাহান্তে আপনার স্ট্র্যাটেজি রিভিউ করুন।
৮. শেয়ার মার্কেট শেখার জন্য সময় দিন
শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের আগে এই সেক্টর সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
বিভিন্ন বই, অনলাইন কোর্স এবং বিশেষজ্ঞদের ভিডিও থেকে শেখার অভ্যাস করুন।
৯. ফিয়ার (ভয়) এবং গ্রিড (লোভ) -
ট্রেডিং সাইকোলজির প্রধান দুশমন
ফিয়ার এবং গ্রিড, বা ভয় এবং লোভ, ট্রেডিংয়ের সবচেয়ে বড় শত্রু। যখন বাজার ওঠানামা করছে, তখন প্রাইস উপরে উঠলে লোভ প্রবল হয়, আর নিচে নামলে ভয় কাজ করে। এই দুটো সাইকোলজির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। যখন আপনি লোভের প্রভাবে বেশি ট্রেডিং করবেন, তখন আপনি আপনার সঠিক পরিকল্পনা বা সিস্টেম অনুসরণ করতে পারবেন না। একইভাবে, ভয়ের প্রভাবে আপনি শেয়ারের দাম কমে গেলে দ্রুত স্টপ লস সেট করে ফেলবেন, যা আপনার লং টার্ম প্ল্যানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে।
কীভাবে ম্যানেজ করবেন?
এক্ষেত্রে, একটি শক্তিশালী ট্রেডিং সিস্টেম তৈরি করা এবং তার প্রতি আস্থা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি জানেন যে আপনার সিস্টেম সঠিক, তাহলে আপনি লোভ এবং ভয়কে পরাজিত করতে পারবেন। এছাড়া, ট্রেডিং প্ল্যান অনুসরণ করে এবং সাবধানে পদক্ষেপ নিলেই সফলতা আসবে।
১০. রিগ্রেট (অনুশোচনা) এবং হোপ (আশা) -
আপনার ট্রেডিং সাইকোলজিকে নষ্ট করতে পারে
অনেক সময় ট্রেডিংয়ের পর আমরা মনে করি যে আরও বেশি লাভ হতে পারতো। আপনি যদি ১০% লাভে ট্রেড ছেড়ে দেন, কিন্তু পরে দেখেন যে বাজার আরও ৯০% উঠে গেছে, তখন অনুশোচনা করতে পারেন। কিন্তু এরকম চিন্তা করবেন না, কারণ আপনার ট্রেডিং সিস্টেমের মাধ্যমে আপনি যে লাভ করেছেন, সেটাই সঠিক।
এছাড়া, ট্রেডিংয়ের সময় আশা বা হোপ আমাদের মধ্যে কাজ করে। অনেক সময় আমরা মার্কেটের প্রাইসের ওঠানামা দেখে আশায় থাকি যে দাম হয়তো আবার উঠবে। কিন্তু এই ধরনের মনোভাব শুধু ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়।
কীভাবে ম্যানেজ করবেন?
আপনার ট্রেডিং সিস্টেমে বিশ্বাস রাখতে হবে। যদি আপনি জানেন যে আপনার সিস্টেমটি ঠিকঠাক কাজ করছে, তাহলে আর এসব চিন্তা করতে হবে না। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে গ্রহণ করা উচিত, এবং লাভ নিতে শিখুন।
১১. ট্রেডিং সিস্টেমের প্রতি আস্থা এবং মেন্টাল ডিসিপ্লিন
প্রথমেই যে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে তা হলো, আপনি যে ট্রেডিং সিস্টেমটি ব্যবহার করছেন, তার প্রতি আপনার আস্থা থাকতে হবে। আপনাকে এই সিস্টেমে মাস্টার হতে হবে এবং এর প্রতিটি দিক ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যদি আপনি একটি সিস্টেমে এক্সপার্ট হন, তবে আপনি সহজেই লোভ, ভয়, অনুশোচনা, এবং আশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
এছাড়া, প্রতিটি ট্রেডের জন্য আপনার একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। পরিকল্পনা ছাড়া ট্রেডিং করা মানে হচ্ছে আপনার ডেস্টিনেশন ছাড়া এক অজানা পথে চলা।
১২. ফেইলিওর থেকে শিক্ষা নেওয়া
কোনও কিছু ১০০% ঠিক হতে পারে না, বিশেষ করে ট্রেডিংয়ে। আপনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে তার মানে এই নয় যে আপনি আর কখনো সফল হতে পারবেন না। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া সাফল্যের চাবিকাঠি। আপনাকে জানতে হবে কেন আপনি ব্যর্থ হলেন এবং কোথায় ভুল হয়েছে। ট্রেডিং জার্নাল রক্ষণাবেক্ষণ করলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন কোন ট্রেডটি কেন ভুল হয়েছে এবং কীভাবে আপনি পরবর্তী সময়ে এই ভুলগুলি এড়াতে পারবেন।
১৩. গুড ট্রেড এবং গুড ট্রেডিং-এর পার্থক্য
একটি ভালো ট্রেড হতে হবে যে আপনি যেটি নিয়েছেন তা প্রফিটের জন্য নেওয়া হয়েছে এবং আপনার পরিকল্পনা অনুসারে। অনেক সময় আমরা ৩০% লাভের দিকে ঝুঁকি নিয়ে বড় ট্রেডে চলে যাই। কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা ছোট ছোট সুযোগগুলো মিস করে ফেলি যা ছোট হলেও নিয়মিত লাভ এনে দেয়।
আপনার লক্ষ্য হওয়া উচিত দীর্ঘমেয়াদী লাভ এবং একটি নির্ভরযোগ্য সিস্টেম অনুসরণ করা। বড় ট্রেডের প্রতি এডিক্টেড না হয়ে, ছোট ছোট লাভের দিকে মনোযোগ দিন।
১৪. প্রফিটের প্রতি এডিক্টেড হওয়া ঠিক নয়
অনেক সময় আমরা স্যালারি বা প্রফিটের প্রতি অতিরিক্ত এডিক্টেড হয়ে পড়ি, যা আমাদের মানসিক অবস্থা ও ট্রেডিংয়ের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শেয়ার মার্কেট একটি সিজনাল বিজনেস, যেখানে কখনো লাভ এবং কখনো ক্ষতি হতে পারে। এটি স্বীকার করে নেয়া জরুরি। আপনার সিস্টেমের উপর নির্ভর করে ট্রেড করুন এবং প্রফিটের জন্য অস্থির না হয়ে, পরিকল্পনা অনুসরণ করুন।
১৫. ট্রেডিংয়ের তুলনায় জীবন অনেক মূল্যবান
অবশেষে, মনে রাখবেন যে ট্রেডিং জীবনের অংশ হলেও, জীবন কখনোই ট্রেডিংয়ের চেয়ে বেশি মূল্যবান। একটি সফল ব্যক্তি তার সাফল্য উপভোগ করতে জানে এবং তার জীবনের গুণমান বজায় রাখে। শুধুমাত্র প্রফিটের পিছনে ছুটলে আপনি আপনার জীবনের অন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই, ট্রেডিংয়ে ফোকাস করুন, কিন্তু আপনার জীবন ও সুখ কে ত্যাগ না করে।
উপসংহার
৯ টা থেকে ৫ টা চাকরি করার পাশাপাশি শেয়ার মার্কেট থেকে আয় করা একেবারে সম্ভব। শুধু দরকার সঠিক পরিকল্পনা, মানসিক দৃঢ়তা, নিজের প্রতি বিশ্বাস, সঠিক সাইকোলজি এবং দক্ষ ট্রেডিং সিস্টেম। উপরোক্ত কৌশলগুলো অনুসরণ করলে আপনি নিশ্চিতভাবে শেয়ার মার্কেট থেকে আয়ের পথে এগিয়ে যেতে পারবেন।
আরো জানতে এই ভিডিওটা দেখুনঃ
আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? নিচের মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না।
0 মন্তব্যসমূহ